ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কয়েক বছর ধরেই নিরাপদ বিনিয়োগের পথ খুঁজছে, যাতে ঋণের টাকা সময়মতো ফেরত আসে। সে কারণে শিল্প খাতে অর্থায়নের পাশাপাশি ফ্ল্যাট কেনা ও বাড়ি নির্মাণেও ঋণ দিচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
গৃহায়ণ খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণদানকে উৎসাহিত করতে একসময় বাংলাদেশ ব্যাংক একটি তহবিলও গঠন করে। সেই তহবিল থেকে কম সুদে অর্থ নিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহক পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে তা ঋণ হিসেবে বিতরণ করত। এতে আবাসন খাতটি ব্যাপকভাবে চাঙা হয়ে ওঠে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তহবিলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাতে এ খাতে ঋণের সুদের হার বেড়ে যায়। আবাসন খাতে মন্দাভাব দেখা দেয়।
অর্ধযুগেরও বেশি সময় ধরে চলা এ খাতের মন্দাবস্থা পার হয়ে এখন সুদিনের হাতছানি। তাই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আবারও এ খাতে ঋণ দিতে এগিয়ে এসেছে। তবে সুদের হার কিছুটা বেশি, ১০ শতাংশের ওপরে। যদিও সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আবাসনে ১০ শতাংশের কম সুদে ঋণ বিতরণ করছে।
ঋণ বিতরণের পাশাপাশি ঋণ প্রক্রিয়াটিও আগের চেয়ে অনেক সহজ করেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রতিষ্ঠানগুলোই এখন ঋণ দিতে ছুটছে গ্রাহকের দ্বারে দ্বারে। শহর ছাড়িয়ে আবাসন ঋণ মিলছে এখন শহরতলি, জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো আবাসন খাতে একজন গ্রাহককে সর্বোচ্চ ১ কোটি ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। তবে ঋণ ও মূলধনে অনুপাত হতে হয় ৭০: ৩০। অর্থাৎ ১ কোটি টাকার ফ্ল্যাটে ব্যাংক ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থায়ন করতে পারবে। বাকি ৩০ লাখ টাকা দিতে হবে গ্রাহককে। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এ নিয়ম প্রযোজ্য হচ্ছে না। তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলে ফ্ল্যাটের দামের পুরো অর্থই ঋণ হিসেবে দিতে পারে।
ব্যাংকগুলো অনেক আগে থেকেই আবাসনে ঋণ দিয়ে এলেও ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আইএফআইসি ব্যাংক প্রথম কম সুদে গৃহঋণ নিয়ে বড় প্রচারে আসে। এরপর অন্য ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ঋণদাতা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও এ পথে হাঁটতে শুরু করে। শুরুতে আইএফআইসি ব্যাংক ১১ দশমিক ৯৫ শতাংশ সুদে গৃহঋণ বিতরণ করে। ওই সময় অন্য ব্যাংকগুলোতে এ খাতে বিতরণ করা ঋণের সুদের হার ছিল ১৫ শতাংশের বেশি। পরে একই বছরের ডিসেম্বরে গৃহঋণের সুদের হার কমিয়ে ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ নির্ধারণ করে আইএফআইসি ব্যাংক। তবে বর্তমানে এ সুদ হার কিছুটা বেড়ে ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
ব্যাংকগুলোর মধ্যে আইএফআইসি ব্যাংকই আবাসন খাতে সবচেয়ে বেশি অর্থায়ন করেছে। জানতে চাইলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুদের হারের কারণে গ্রাহকেরা ফ্ল্যাট কেনার চিন্তাই করতেন না। ব্যাংক হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব ছিল গ্রাহককে এ বিষয়ে সহায়তা করার। সেটা আমরা করতে পেরেছি, এ কারণে আবাসনে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ গেছে।’
শাহ আলম সারওয়ার বলেন, ‘আমাদের ঋণে গ্রাহকের ভালো সাড়া মিলছে। ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীসহ সব পেশার মানুষই এ ঋণ নিচ্ছেন। আমরা মনে করি, আমাদের আবাসন ঋণ বাজারের সবচেয়ে ভালো সেবা পণ্য। কারণ আমাদের অতিরিক্ত কোনো মাশুল নেই।’
এদিকে ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও আবাসন খাতে ভালো অর্থায়ন করছে। সরকারি খাতের হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন তো পুরোপুরি এ সেবায় নিয়োজিত। এ প্রতিষ্ঠানটি শহরের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলাতেও ঋণ দিচ্ছে। বাড়ি নির্মাণ ও সংস্কারেও ঋণ দিচ্ছে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি। সুদহারও ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে। আর বেসরকারি খাতের ডেলটা ব্র্যাক হাউজিং ফিন্যান্স করপোরেশন (ডিবিএইচ) ও ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টও পুরোপুরি আবাসন ঋণের সঙ্গে জড়িত।
দেশে আবাসন খাতে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে ডিবিএইচ। এ খাতে প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ১০ শতাংশ সুদে এ খাতে ঋণ দিচ্ছে ডিবিএইচ। জানতে চাইলে ডিবিএইচের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. শরিফুল আলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফ্ল্যাটের চাহিদা বাড়ছে, পাশাপাশি দামও সমন্বয় হচ্ছে। এ খাতে সুদের হারও কমেছিল। তবে এখন বাড়তে শুরু করেছে।’
এদিকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক নতুন করে আবাসন খাতের ঋণে জোর দিয়েছে। ব্যাংকটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বাড়ি নির্মাণে ‘সোনালী নীড়’ নামে প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার সুদ হার ৭ শতাংশ। এর বাইরে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ইসলামী, ব্র্যাক, ইস্টার্ণসহ কয়েকটি ব্যাংক ফ্ল্যাট কিনতে ঋণ দিচ্ছে। ডেলটা ব্র্যাক ও ন্যাশনাল হাউজিং ছাড়াও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এ খাতে ঋণ বিতরণে ভালো অবস্থায় রয়েছে আইডিএলসি, আইপিডিসি, লংকাবাংলা ফিন্যান্স।
সম্প্রতি নতুন ফ্ল্যাট কেনা বেসরকারি একটি সংস্থায় কর্মরত রিফাত আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘নিজের টাকায় কখনো ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব হতো না। ব্যাংক ঋণ দেওয়ায় সেটা সম্ভব হয়েছে। ২০ বছরে তাঁর ঋণ শোধ হয়ে যাবে।’
এদিকে প্রবাসীদের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে ঋণের সুযোগ বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশে বাড়ি নির্মাণ বা ফ্ল্যাট কিনতে প্রবাসীরা এখন মোট ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যাংক ঋণসুবিধা পাবেন। আগে ব্যয়ের অর্ধেক পরিমাণ ঋণ নেওয়ার সুযোগ ছিল। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো দেশের ব্যাংক থেকে আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রবাসীদের ঋণ নেওয়ার সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
সুত্র:- প্রথম আলো